সুলতানী আমলে বাংলার ইতিহাসের উপাদান বা উৎসসমূহ
সুলতানী আমলে বাংলার ইতিহাসের উপাদান বা উৎসসমূহ
মুসলমান জাতি ইতিহাস সচেতন। ভারত উপমহাদেশের হিন্দু এবং মুসলমান আমলের ঐতিহাসিক উপাদান পরীক্ষা করিলে এই উক্তির সত্যতা প্রমানিত হয়। প্রফেসর ডডওয়েল বলেনঃ মুসলমান আমল শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতে ধারাবাহিকভাবে ইতিহাস লেখা শুরু হয় ফলে মুসলমান আমলের যেমন জীবন্ত চিত্র পাওয়া যায় -হিন্দু আমল তেমনই ছায়াচ্ছন্ন। দ্বিল্লীর সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় বা পৃষ্ঠপোষন ছাড়াই সমসাময়িক কালে অনেক, ইতিহাস গ্রন্থ লিখিত হয়। এই সব গ্রন্থের সাহায্যে দিল্লীর সুলতানদের ধারাবাহিক ইতিহাস পুনর্গঠন করা মোটেই কষ্টকর নয়। মোগল আমলে প্রত্যেক মোগল সম্রাট সরকারী ভাবে ঐতিহাসিক নিযুক্ত করিয়া নিজ নিজ সময়ের বা পূর্ববর্তী কালের ইতিহাস লিখার রীতি প্রচলন করেন। ইতিহাস-সাহিত্য এত জনপ্রিয়তা লাভ করে যে দরবারী ঐতিহাসিক ছাড়াও আরও অনেকেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া ইতিহাস লিখিতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য- বলত সুলতানী আমলে বাংলাদেশে লিখিত কোন ইতিহাস গ্রন্থ এই পর্যন্ত আবিষ্কৃত নী আমলে লিখিত রিয়াজ- হয় নাই। পরবর্তীকালে রিয়াজ-উস-সালাতীন বা বুকাননের বিবরনে দুই একটি অধুনালুপত ফার্সী পান্ডুলিপির নির্দেশ পাওয়া যায়। সমসাময়িককালে লিখিত ইতিহাস গ্রন্থের অভাবে সুলতানী আমলে বাংলাদেশের ইতিহাস পুনর্গঠন করা কঠিন, তবে একেবারে অসম্ভব নয়; কারন দিল্লীতে লিখিত অনথ এবং বাংলাদেশের প্রাপত সূত্রে র অনেক তথ্য পাওয়া যায় যাহার সাহায্যে আধুনিক পন্ডিতেরা বাংলাদেশের ইতিহাস পুনর্গঠন করার প্রয়াস পাইয়াছেন।সুলতানী ইতিহাসের উপাদানকে নিম্নরুপে ভাগ করা যায়:
ক)আরবী ও ফার্সী ভাষায় লিখিত ইতিহাস ও অন্যান্য গ্রন্থ,
খ)সূফীদের জীবনচরিত সূফীদের লিখিত চিঠি এবং আলোচনা,
গ) সমসাময়িক শিলালিপি ও মুদ্রা,
ঘ) বিদেশী পরিব্রাজকদের বিবরণ,
ঙ)বাংলা সাহিত্য।
ক. আরবী ও ফার্সী ভাষায় লিখিত ইতিহাস ও অন্যান্য গ্রন্থ
১.তবকাত-ই-নাসিরীঃ
সমসাময়িক কালে লিখিত বাংলাদেশের কোনো ইতিহাস গ্রন্থ পাওয়া যায় নাই, সমসাময়িক ইতিহাস প্রশ্নগুলো সবই বাংলাদেশের বাহিরে, বিশেষ করিয়া দিল্লীতে বসিয়া লিখিত। এই সকল ইতিহাস মধ্যে আবু গ্রন্থের আবু উমর মিনহাজ- উদ-দীন বিন সিরাজ 100 উদ-দীন আল-জুজযানীর তবকাত-ই-নাসিরী সর্বাগ্রে লিখিত ৷ লেখককে সংক্ষেপে মিনহাজ-ই-সিরাজ নামে অভিহিত করা হয়। তিনি করতে আগমন করার পরে প্রথমে মুলতানের সুলতান নাসির-উদ-দীন কুবাচার অধীনে কাজীর পদ গ্রহন করেন। পরে তিনি দিল্লীতে আসেন এবং দিল্লীর সুলতান ইলতুতমিশ ও তাঁহার উত্তরাধিকারী- দের সময়ে দিল্লীর কাজীর পদ গ্রহণ করেন।
মিনহাজ-ই-সিরাজ তাহার তবকাত-ই-নাসিরী দিল্লীর সুলতান নাসির উদ-দীন মাহমুদের (১২৪৬ - ১২৬৬) খ্রী: নামে উৎসর্গ করেন । এইজন্য গ্রন্থটির নাম তবকাত-
ই-নাসিরী রাখা হয়। যদিও তবকাত - ই - নাসিরী ইতিহাস, অনথাকা প্রকৃতপক্ষে একটি ইসলামের গ্রন্থাকার তাঁহার বইখানিতে বাংলাদেশের মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস লিপিবদ্ধ করিয়া একটি অধ্যায় সংযোজন করেন। মালিক ইজজ উদ-দীন তুগরল তুগান খান যখন লখনৌতির গভর্নর ছিলেন (১২৩৩ - ১২৪৪ খ্রীঃ) তখন মিনহাজ- ই সিরাজ লখনৌতি আগমন করেন এবং তুগরল তুগান খান ও মালিক তমব খান কিরানের মধ্যে বিরোধের দেখা দিলে তিনি উভয়ের মধ্যে মধ্যস্থতা করেন৷ বাংলাদেশে অবস্থানের 'সময় মিনহাজ- ই - সিরাজ মুসলমানদের বাংলাদেশ বিজয় সম্পর্কিত তথ্যাদি অনুসন্ধান করেন; বসতিয়ার খলজীর সময়কার সৈনিকদের মধ্যে মুমতালিদ উদ-দৌলা নামক এক ব্যক্তির নিকট হইতেও তিনি তথ্যাদি সংগ্রহ করেন। মুসলমানদের বাংলাে বিজয়ের কাহিনী এবং বাংলাদেশে সমলুক শাসনের কিছু অংশের বিবরন শুধু মিনহাজ-ই-সিরাজের তবকাত-ই- নাসিরীতেই পাওয়া যায়। তাছাড়া মিনহাজ দিল্লীর আমীরদের সম্বন্ধে আলোচনা করার সময় লখনৌতিতে নিযুক্ত গভর্নরদের কার্যকলাপ সর্ম্পকেও বেশ আলোকপাত করেন ৷
তারিখ-ই-ফিরোজশাহী:
তবকাত ই-নাসিরীর পরে জিয়া-উদ-দীন বরনীর তারিখ-ই-ফিরোজ শাহী লিখিত হয় । মিনহাজের তবকাত-ই-নাসিরীতে ১২৬১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ হইয়াছে। জিয়া-উদ-দীন বরনী সুলতান গিয়াস-উদ-দীন বলবনের সিংহাসন আরোহনের সময় (
(১২৬৬ খ্রীঃ) হইতে শুরু কবিয়া সুলতান ফিরোজশাহ তুঘলকের রাজত্বের প্রথম ছয় বৎসর পর্যন্ত (১৩৫৭ খ্রীঃ) সময়ের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন। জিয়া-উদ-দীন বরনী উচ্চবংশে জন্মগ্রহন করেন; তাহার পিতা মুইদ-উল- সুলক, চাচা আলা মুলক, মাতামহ হিসাম-উদ-দীন সকলেই দিল্লীর সুলতানদের অধীনে উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত ছিলেন। জিয়া-উদ-দীন বরনী নিজেও সুলতান মোহাম্মদ বিন তুঘলকের বিশ্বস্ত অনুচর ছিলেন এবং সুলতানের মৃত্যুর পর্যন্ত প্রায়ই তাঁহার দরবারে উপস্থিত থাকিতেন৷ 'জিয়া- উদ-দীন বরণী সুলতান গিয়াস -উদ-দীন বলবনের রাজত্বকালে জন্মগ্রহণ করেন; সুতরাং সুলতান বলবনের সময় হইতে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি বেশ কয়েকজন দিল্লীর সুলতানের সমসাময়িক ছিলেন। বলবন জন্য এবং প্রথম দুই একজন খলজী তিনি তাহার আত্মীয় এবং অন্যান্য সুলতানের ইতিহাস রচনার উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীর নিকট হইতে তথ্য সংগ্রহ করেন। পরবর্তী খলজী এবং মোহাম্মদ বিন তুঘলকের সময়ের ঘটনাবলীর সঙ্গে তিনি সুপরিচিত ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত জিয়া- উদ-দীন বরণী কোন সময় বাংলাদেশে আসেন নাই। বাংলাদেশের আরবী ভাষায় ঘটনাবলী জানার জন্য তিনি বাংলাদেশ প্রত্যাগত সৈনিক বা সুলতানের দরবার ম দবীর (সেক্রেটারী) দের নিকট হইতে খবর সংগ্রহ করেন। বরনী যে সময়ের ইতিহাস লিখেন (১২৬৬-১৩৫৭ খ্রীঃ) অধিকাংশ সময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন ছিল। তাই হয়তো ইচ্ছা থাকা থাকা সত্ত্বেও তিনি খবরাখবর বিশেষ সংগ্রহ করিতে পারেন নাই। মাত্র দুই - একটি বিষয় ছাড়া বরনীর তারিখ-ই-ফিরোজশাহীতে - বাংলাদেশের ঘটনাবলী অতি সংক্ষেপে বর্ণনা করা হইয়াছে, তবুও তিনি যতটুকু লিপিবদন করেছেন করিয়াছেন, তাহাতে বিশেষ ভুল সংবাদ পাওয়া যা যায় না। দিল্লীর সুলতান এর পৃষ্ঠপোষন লাভের উদ্দেশ্যেই বরনী তাঁহার বইখানি লিখেন তাই বিদ্রোহী হী বাংলাদেশের প্রতি তাঁহার মনোভাব মোটেই সহানুভূতিশীল ছিলনা। তিনি বাংলাদেশকে "বলগাকপুর ” বা বিদ্রোহী দেশরূপে আখ্যায়িত করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীন সুলতানের সর্ম্পকেও প্রায়ই বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করেন।এই সকল মন্তব্য সত্ত্বেও বরণীর তারীখ - ই - ফিরোজশাহী ঐতিহাসিক উপাদানের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান।
ফুতুহ-উস-উস-সালাতীনঃ
খাজা আবদুল মালিক ইসামী ১৩৪৯ খ্রীঃ তাঁহার ফুতুহ-উস- "গ্রন্থখানি লিখেন। সুলতান মোহামম্মদ বিন তুঘলক তাঁহার প্রধান আসতাদিগকে দিল্লী হইতে দেবগিরি (দৌলতাবাদ) যাওয়ার জন্য আদেশ দিলে ষোল বৎসর বয়ক ইসামী তাঁহার পিতামহ আজ্জ -উস- দীনের সঙ্গে দেবগিরি যান।
সেখানে ইসামী প্রথম বাহমনী সুলতান আলা-উদ-দীন হাসনের সময় খানি রচনা করেন। বইখানী কবিতায় লিখিত এবং সেই কারণে পন্ডিতেরা মনে করেন যে, বইখানি অতিরঞ্জন দোষে দুষ্ট। ইসামীও কোন সময় বাংলাদেশে আসেন নাই, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ইসামীর ইতিহাস এ এমন কিছু তথ্য পাওয়া যায় যাহা জিয়া উদ্দীন বরনীর তারিখ-ই- ফিরোজ শাহীতে পাওয়া যায় না। ইহাতে মনে হয় যে, বিদ্রোহী বাহমনী রাজ্যের সঙ্গে বিদ্রোহী ছিল এবং উভয় বিদ্রোহী বাংলাদেশের দেশের মধ্যে লোকজনের যাতায়াত ছিল। ফলে ইসামী বাংলাদেশের সর্ম্পকে তথ্য অনুসন্ধান করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।
সীরাত -ই-ফিরোজশাহী:
সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের সময়ে সীরত ই ফিরোজশাহী নামে আর একখানি ইতিহাস গ্রাম লিখা হয়। এই বইয়ে লেখকের নাম পাওয়া যায় না, তবে পন্ডিতেরা মনে করেন যে বইখানী ফিরোজ শাহ তুঘলকের আদেশে রচিত হয়। আবার কেহ কেহ মনে করেন যে, ফিরুজ শাহ তুঘলক নিজেই বইখানী রচনা করেন। এই বইয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে সামান্য বিবরন পাওয়া যায়৷
তারীখ-ই-মোবারকশাহী:
দিল্লীর সৈয়দ সুলতান মোবারক শাহের রাজত্বকালে (১৪২১ - ১৪৩৪) খ্রীঃ) ইয়াহইয়া বিন আহমদ রি বিন আবদুল্লাহ সরহদী রচনা করেন। ব তাঁহার তারিখ ই- ই-মোবারকশাহী বইখানীতে সুলতান মোহামম্মদ ঘোরী হইতে আরসভ করিয়া ১৪২৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যনত দিল্লীর সুলতানদের ইতিহাস লিখিত হইয়াছে। সঙ্গে লেখক বাংলাদেশের ইতিহাস সর্ম্পকের আলোকপাত করেন। তারীখ- সঙ্গে লেখক বাংলাদেশের প্রাপ্ত তথ্যগুলি প্রায়ই নির্ভুল প্রমানিত হয়।
উপরোক্ত ইতিহাস গ্রন্থগুলি সমসাময়িককালে লিখিত কিন্তু একমাত্র মিনহাজ ই সিরাজ ব্যতীত লেখকদের মধ্যে অন্যকেহ বাংলাদেশে আসেন নাই। তাছাড়া অধিকাংশ সময় বাংলাদেশ স্বাধীন দিল্লী বা বাংলাদেশের না থাকায় বাহিরে লিখিত ইতিহাস এ বাংলাদেশ সর্ম্পকে বিস্তারিত বিবরন পাওয়া যায় না।
রিয়াজ-উস-সালাতীন :
গোলাম হোসেন সলীম ১৭৮৮ খ্রীস্টাব্দে রিয়াজ-উস-সালাতীন রচনা করেন। বাংলাদেশে ফার্সী ভাষায় আমলের লিখিত মাত্র দুটি গ্রন্থে সুলতানী আমলের ইতিহাস পাওয়া যায়। এইগুলো হচ্ছে সৈয়দ গোলাম হোসেন সলীম জাইদপুরীর রিয়াজ-উস-সালাতীন এবং মুনশী এলাহী বখনের সুরশীদ জাহান নুমা। রিয়াজ ওম- সালাতীন ফার্সী ভাষায় এবং ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হইয়াছে৷ গোলাম হোসেন সলীম রিয়াজ উস-সালাতীন গ্রন্থে মুসলিম বাংলার সম্পূর্ণ ইতিহাস রচনা করিয়াছেন । তিনি তাঁহা পূর্ববর্তী অনর্থ হতে তথ্য সংগ্রহ করিয়াছেন। তিনি জন্য উত্পীর আদেশে "বিয়াজ উস-সালাতীন" গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে পরলোকগমন করেন। তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল হইতে বিশেষ করিয়া গৌড় ও পান্ডুয়া হইতে ঐতিহাসিক উপাদান সংগ্রহ করে। তিনি সুলতানী আমলের মুদ্রার সঙ্গেও পরিচিত ছিলেন । সমসাময়িক বা পরবর্তীকালের ইতিহাস গ্রন্থগুলির মধ্যে একমাত্র রিয়াজ-উস- সলাতীন ও বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থা, জলবায়ু, উৎপন্ন কৃষি ও শিল্প দ্রব্যাদির বিবরণ পাওয়া যায়। আইন-ই-আকবরীতে বর্ণিত বাংলাদেশের ১৯টি ই সরকার এবংঢাকা, মুর্শিদাবাদ ইত্যাদি বড় বড় শহরের ভৌগলিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা সর্ম্পকেও রিয়াজ-উস-সালাতীন এ আলোচনা করা হইয়াছে। তাছাড়া এই গ্রন্থে মুসলমানদের বাংলাদেশ বিজয়ের প্রাক্কালে হিন্দু রাজাদের সম্বন্ধেও আলোচনা করা হয়েছে।
সুফী-সাহিত্যঃ
সূফী সাহিত্যকে সূফীদের জীবনী, সূফীদের লিখিত চিঠি এবং সূফীদের আলোচনা এই তিন ভাগে ভাগ করা যায় । মুলমানদের বাংলাদেশে বিজয়ের পর হইতে অনেক মুসলমান সূফী সাধক মধ্য এশিয়া এবং উত্তর ভারত হইতে বাংলাদেশে বিজয়ের পর হইতে অনেক মুসলমান সুফী সাধক এশিয়া এবং উত্তর ভারতে হইতে বাংলাদেশে আগমন করেন। তারা এই দেশে খানকাহ এবং মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং মুসলমানদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। বাংলাদেশেও বেশ কয়েকজন বিখ্যাত সুফীর জন্ম হয়, বাংলাদেশে ইসলাম বিস্তারে সূফীদের দান অত্যন্ত বেশী। যুগে যুগে বিভিন্ন ব্যক্তি ইসলামের বিস্তারের জন্য এক দেশ থেকে অন্য দেশে নানাভাবে অবদান রাখেন তারাই সূফী বাংলাদেশের বাইরে লিখিত সূফীদের জীবনচরিত অনেক পাওয়া যায়। হয় শাহ শোয়ের বিহারের মানের শরীফের বিখ্যাত সূফী শায়খ শরফ-উদ-দীন মানেরীর জীবনী অবলম্বন করিয়া মনাকিব-উল-আসফিয়া নামক বই লেখেন, শায়খ আব্দুল হক দেহলভীর " আখবার-উল- আখইয়ার” এবং আবদুর রহমান চিশতীর "মিরাত-উল- আসবাব গ্রন্থদ্বয়ে বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন সূফীর জীবনী আলোচনা করা হয়েছে। সেখ-সুভেচ্ছায় শায়খ জালাল-উদ-দীন -তবেরজীরত জীবনী আলোচনা করা হয়েছে। তদশ শতকে মোগল সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে পীর মোহামম্মদ সত্তারী রিসালাত-উশ- -সুহাদা নামক একখান বই লিখেন। রিসালাত উশ-শুহাদার বিবরণ ই অত্যন্ত মূল্যবান। নাসির উদ-দীন হায়দর ১৮৫৯ খ্রী: সুহেল ই -এমন নামক বই লেখেন। এতে সিলেটের শাহজালালের জীবনী আলোচনা করা হইয়াছে। এই সুহেল হয় মন এর 'সাক্ষ্য অনেকাংশে নির্ভরযোগ্য নয়, কিন্তু তবুও এই বই এ শাহজালালের সম্পূর্ণ জীবনকাহিনী পাওয়া যায়। সূফীদের আলোচনাকে মানবত বলা হয়। সূফীদের লিখিত চিঠিপত্রেও ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়। এই পর্যন্ত আবিষ্কৃত বিজন সূফীর লিখিত চিঠিপত্র বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার বিবরণ পাওয়া যায়। তারা হলেন:- পান্ডুয়ার শায়খনুর কুতুব আলম, জৌনপুরের মীর সৈয়দ আশারফ জাহাঙ্গীর সিমনানী এবং বিহারের শায়খ মুজাফফর শামস বলখী।
শিলালিপি ও মুদ্রা:-
বাংলাদেশে মুসলমান সুলতানগণ কর্তৃক উৎকীর্ণ অনেক
শিলালিপি ও মুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে। ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে শিলালিপিও ক্ষুদ্রার সাক্ষ্য সর্বাপেক্ষা মূল্যবান কারণ এই গুলি শুধু সম সাময়িকাই নয়, বরং স্বয়ং সুলতান বা তাঁহার উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের প্রত্যক্ষ তদারককের মাধ্যমে মুদ্রা ও শিলালিপি উৎকীর্ণ হতো। শিলালিপিতে সাধারণত কোরানের আয়াত বা শ্লোক, -হাদিস বা রাসূলের বচন, সুলতানের নাম ও পরিচয়, যেই অফিসার কর্তৃক শিলালিপি উৎকীর্ণ তাহার নাম ও পরিচয় এবং তারিখ উৎকীর্ণ হইত। মুদ্রায় সাধারনত কালেমা, চার খলিফার নাম, সুলতানের নাম ও পরিচয়, সেই অফিসার তারিখ এবং টাকশালের নাম উৎকীর্ণ হতো। মুদ্রায় উৎকীর্ণ টাকশালের নাম এবং শিলালিপির প্রাপ্যিানের সাহায্যে বিভিন্ন সময়ে মুসলিম রাজ্যের বিস্তৃতির সংবাদ পাওয়া যায়। তাছাড়া শিলালিপিগুলি সাধারণত মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ, প্রাসাদ, পুল এবং কুয়া কী ইত্যাদি নির্মাণ বা খননের সময় উৎর হতো • ফলে শিলালিপির সাহায্যে মুসলমান সমাজ সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া যায়। কোন কোন মুদ্রায় এবং শিলালিপি। তে সুলতানদের রাজ্যবিস্তার রি সর্ম্পকেও ইলিয়াছ শাহী তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে। ইলিয়াছশাহী বংশের শেষ সুলতান আলা-উদ্ দীন ফীরুজ শাহ এবং সোনার গাঁও এর ৯ ইখতিয়ার উদ্দীন গাজী শাহের নাম কোন ইতিহাস গ্রন্থে পাওয়া সুলতান যায় না, শুধু মুদ্রার সাক্ষ্যেই তাদের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া য যায়। শিলা- লিপি ও মুদ্রা আবিষ্কৃত না হইলে বাংলার ইতিহাসের অনেক কিছুই আমাদের অজানা থাকত। এই জন্য প্রত্নতাত্ত্বিক, শিলালিপি ও মুদ্রা বিশেষজ্ঞ নিকট ঐতিহাসিকেরা ঋণী।
বিদেশী পর্যটকদের বিবরনঃ
বিদেশী পর্যটকদের মধ্যে মরক্কোর মুসলমান পর্যটক ইবনে বতুতা মুসলমান আমলে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে আগমন করেন। তিনি উত্তর আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাসমূহ ভ্রমণ শেষ করে ১৩০৩ খ্রীঃ সুলতান মোহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালে দিল্লীতে আসেন, এবং দিল্লীর সুলতান কর্তৃক - এবং চীনে রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হয়ে চীন যাওয়ার পথে ১৩৪৬ খ্রীষ্টাব্দে বাংলাদেশে সফর করেন। তার সফরনামায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ( সামাজিক অবস্থা সর্ম্পকে আলোকপাত করা হয়েছে। ইবনে বতুতা প্রদত্ত সামাজিক ও অর্থনৈতিক আগুলি অত্যন্ত মূল্যবান। তিনি নিজে বাংলাদেশের বাজার দেখেন এবং বাজারে প্রাপত জিনিসপত্রের দাম উল্লেখ করেছেন। চীনের রাষ্ট্রদূত মাওয়ান (১৪২৫-১৪৩২) খ্রী: মধ্যে Ying Yai Sheng Jan সংকলিত করেন। এই বিবরণে বাংলার সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা লিখিত হইয়াছে, কিন্তু সুলতান বা তাঁহার দরবারের কোন উল্লেখ নেই। ১৪৩৬ খ্রীষ্টাব্দে ফি-সিন কর্তৃক সংকলিত sing cha seng Ian এই বিবরণেও বাংলাদেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। সুলতান এবং সুলতানের দরবারের উল্লেখ আছে কিন্তু সুলতানের নাম উল্লেখ করা হয়নি। ইউরোপীয় পরিব্রাজকদের মধ্যে নিকলো দি-কণিত, অদো-অ-গামা, ভারথেমা, বারবোসা, সিজার ফ্রেডারিক এবং তোমে পিরেস মূল্যবান তথ্য লিপিবদল করেছেন। পর্তুগিজ নাবিক অঙ্কো- দা গামার নাম অতি সুপরিচিত, তিনি ১৪৯০ খ্রীস্টাব্দে ইউরোপ হতে ভারতের সমুদ্রপথ আবিষ্কার করেন, বাংলাদেশ সম্পর্কেও তাঁহার ও সামান্য মন্তব্য পাওয়া যায়। জোয়া ও ডি বেরস একজন বিখ্যাত পর্তুগীজ ঐতিহাসিক তিনি "দি এশিয়া" গ্রন্থের রচয়িতা। তিনি বাংলাদেশের আসেন নাই, কিন্তু পর্তুগীজ বনিকদের নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং বিবরন ও রাজদরবারে গ্রন্থাকারে রক্ষিত তথ্যাদি অনুসরণ করে তার গ্রন্থ রচনা করেন। তার ইতিহাস গ্রন্থে সুলতান গিয়াস-উদ-দীন মাহমুদ শাহের রাজত্বকালের ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যঃ-
সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যেও ইতিহাসের উপাদান পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যে প্রধানত সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা এবং জনসাধারণের জীবনযাত্রা প্রণালী সর্ম্পকে উপাদান পাওয়া যায়। সমসাময়িক হিন্দু এবং মুসলমান কবিরা কাব্য রচনা করেন ৷ হিন্দু কবিদের কাব্য হলো, চন্ডিদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, কৃত্তিবাসের রামায়ন, মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণ বিজয় বিজয়গ্রুপের সমসাম জ্বাল বিশ্বাস পিপলাই এর মনসা বিজয়, কবীন্দ্র পরমেশ্বরের মহাভারত, শ্রীকর নন্দনীর মহাভারত (অশ্বমেধ পর্ব) এবং দ্বিজ শ্রীধরের বিদ্যাসুন্দর। মুসলমান কবিদের লিখিত একমাত্র কাব্যগুলি শাহ মোহামম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা। বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনে বাংলা সাহিত্যে প্রাপত তথ্যাদি অত্যন্ত মূল্যবান
No comments
Do leave your comments