লর্ড কার্জনের শিক্ষা নীতি আলোচনা কর?
লর্ড কার্জনের শিক্ষা নীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য কি ছিল? তার এই নীতির ব্যাপারে ভারতীয়দের কি প্রতিক্রিয়া ছিল? বুদ্ধিস্ট শিক্ষা ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য কী ছিল? এই শিক্ষা ব্যবস্থার বিবরন দাও ?
ভূমিকাঃ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ভরতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায়। ভারতীয় শিক্ষা সংস্কারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কমিটি ও কমিশন গঠিত হয়। তাদের সুপারিশ অনুসারে ভারতে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদিধ পায়। তার সাথে সাথে ছাত্র সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার কোনো সংস্কার না হওয়ায় পঠন-পাঠনের কাজ সুষ্ঠুভাবে চালানো সম্ভব হচ্ছিল না ফলে শিক্ষার গুনগত মান হ্রাস পেতে থাকে। শিক্ষা ব্যবস্থা পরীক্ষামুখী হয়ে পড়ে এবং ইংরেজি শিক্ষার প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এবং উচ্চশিক্ষা কেবল কেরানি তৈরির কারখানায় পরিণত হয়। শিক্ষা প্রসারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এই রকম পরিস্থিতিতে ভারতীয়দের মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি হয় এবং তারা পাশ্চাত্য শিক্ষার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এই সময় (1898 খ্রিঃ) লর্ড কার্জন ভারতে বড়লাট বা গভর্নর হয়ে আসেন। তিনি ভারতের সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহন করেন । 1904 খ্রিঃ এ মার্চ লর্ড কার্জন ও সরকারি সিদ্ধাতের আকারে একটি শিক্ষানীতি প্রকাশ করেন। এটি "Government of indias Resolution of Education policy "( 1904) নামে পরিচিত।
লর্ড কার্জন যে নীতিগুলো গ্রহন করার কথা বলেন তা নীচে উল্লেখ করা হলো:
১.প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ে কার্জনের নীতিঃ
প্রাথমিক শিক্ষার মনোন্নয়নের জন্য যে নীতিগুলি উল্লেখ করা হয়, সেগুলি হল :
২.ব্যায় বরাদ্দ বৃদ্ধি : দেশের জন্য সরকার যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করবে, তার বেশিরভাগ অংশই প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ব্যয় করা হবে।
৩.সরকারি নিয়ন্ত্রনঃ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রাথমিক শিক্ষা বিকাশের জন্য গৃহিত পরিকল্পনাকে কার্যকরী করার পূর্বে নিজ নিজ প্রদেশের শিক্ষা অধিকর্তার (DPI) অনুমোদন নিতে হবে।
৪.ফলাফলের ভিত্তিতে অনুমোদনের নীতি বর্জন: আগে পরীক্ষার ভিত্তিতে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলি অনুদান পাওয়ার যোগ্য কি না তা বিবেচিত হত।কার্জনের প্রস্তাবে ফলাফলের ভিত্তিতে অনুদান প্রদানের নীতি বর্জন করার কথা বলা হয় ।
৫.পাঠ্যক্রম প্রণয়নঃ- গ্রামাঞ্চল এবং শহরাঞ্চলের প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যক্রমকে পৃথকভাবে রচনা করার কথা বলা হয়। বলা হয় গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলির পাঠ্যক্রমকে হতে হবে সহজ সরল।
৬.শিক্ষার মাধ্যমঃ- শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা। অন্য কোনো ভাষার প্রয়োগ চলবে না।
৭. অর্থব্যয় বিষয়ে তদারকি: প্রাথমিক শিক্ষা সম্প্রসারনের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সরকার অনুদান হিসেবে যে অর্থ ব্য প্রদান করবে, তা যাতে অন্য খাতে ব্যয় না হয়, সেদিকে সরকারকে বিশেষ ভাবে নজর দিতে হবে।
৮. শিক্ষক- প্রশিক্ষনের ব্যাবস্থা: প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদানে নিযুক্ত শিক্ষকেদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিবীর জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য সরকারিভাবে উপযুক্ত সংখ্যক শিক্ষক শিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।
৯.সংখ্যাগত ও গুনগত মানোন্নয়নঃ মানোন্নয়নের প্রাথমিক শিক্ষার সখ্যাগত বিষয়ে সরকারকে আরও বেশি সচেষ্ট হতে হবে।
★★ মাধ্যমিক শিক্ষা বিষয়ে কার্জনের নীতিঃ সরকারি শিক্ষানীতিতে মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য যেসব ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয় তা নিচে উল্লেখ করা হলোঃ-
সরকারি অনুমোদনঃ- শিক্ষা - সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত প্রকাশের পর ইতিমধ্যে দেওয়া সরকারি অনুমোদন ব্যতীত নতুন মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা যাবে না। যেকোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় উভয়ের কাছেই অনুমোদন নিতে হবে, এবং এর জন্য বিধিনিষেধ গুলি সঠিকভাবে মেনে চলতে হবে। অনুমোদিত মাধ্যমিক বিদ্যালয়-গুলিকে সরকারি তহবিল থেকে প্রয়োজনীয় আর্থিক অনুদান মঞ্জুর করা হবে।
শিক্ষক প্রশিক্ষনের ব্যবস্থাঃ- মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষক যাতে নতুন নতুন শিক্ষাপদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন এবং তাদের পেশাগত দক্ষতা বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ পান ক্ষে তার জন্য শিক্ষক-শিক্ষনের ব্যবস্থার পুনবিন্যাস ঘটাতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষক-শিক্ষনের জন্য মহাবিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে।
শিক্ষার ব্যবস্থাঃ- প্রাথমিক স্তরের মতো মাধ্যমিক করে ও শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা। তবে ইংরেজি বিষয়ও চর্চার ব্যবস্থা থাকবে।
আদর্শ বিদ্যালয় স্থাপন: মাধ্যমিক শিক্ষার গুনগত উৎকর্ষ সাধনের জন্য সম্পূর্ণভাবে সরকারি পরিচালনায় কিছু বিদ্যালয় অথাপন করা হবে, যা বেসরকারি বিদ্যালয়গুলির কাছে আদর্শ হিসেবে কাজ করবে।
★★উচ্চশিক্ষা প্রসঙ্গে কার্জনের নীতিঃ লর্ড কার্জন উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কেবল ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন গঠন (1902), করেই তার দায়িত্ব শেষ করেননি। বরং 1901 খ্রী: ২০ মার্চ " ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল এ প্রথম ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বিল উপস্থাপন করেন।
নিচে ভারতের উচ্চশিক্ষার বিষয়ে কার্জনের গৃহিত ব্যবস্থাগুলি উল্লেখ করা হলোঃ-
পঠনপাঠনের ব্যবস্থা: বিশ্ববিদ্যালয়গুলি শুধুমাএ পরীক্ষা গ্রহন ও ডিগ্রি প্রদানের যন্ত্র নয়। এগুলিতে স্নাতকোত্তর ঘরের পঠনপাঠন এবং গবেষণার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন
সিনেট ও সিন্ডিকেট গঠনের নিয়মঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে অধিক সদস্যদের মধ্যে মতের পার্থক্য থাকায় অনেক ক্ষেত্রে দেখা দেয়। ফলে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আচলাবস্থা দেখা দেয়। তাই সিনেট ও সিন্ডিকেটের সদস্যসংখ্যা যথাক্রমে ৫০ থেকে ৩০০ এবং ৩ থেকে ১৫ এর মধ্যে রাখা দরকার।
কলেজ গুলির মানোন্নয়নঃ কলেজগুলির শিক্ষাগত মান ক্রমশ নিম্নগামী হচ্ছে। এই অবস্থার জন্য কলেজগুলিতে যথাযথ পরিদর্শন ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন ।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ভৌগোলিক সীমা নির্ধারন:- প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌগোলিক সীমা নির্ধারণের দায়িত্ব - স পরিষদ গর্ভনর জেনারেলে অর্পন করা হয়। এক্ষেত্রে বলা হয় যে, বিশ্ববিদ্যালয় গুলির ভৌগোলিক সীমানা নির্দিষ্ট করা হলে, বিশ্ববিদ্যালয় গুলিরক্ষেত্রে কাজের সুবিধা হবে।
ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের লর্ড কার্জনের অবদানঃ
ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারে লর্ড কার্জন অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
★1902 খ্রী: ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন নিয়োগ, : ★1902 খ্রীঃ ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রনয়ন,
★1904 খ্রী: শিক্ষানীতির ওপর সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহন।
লর্ড কার্জনের নীতিতে ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়াঃ লর্ড কার্জন শিক্ষার নীতি প্রনয়নের পর ভারতীয়দের সমালোচনার স্বীকার হন।
কারন ভারতীয়রা চেয়েছিলেন স্বায়ত্তশাসিত এবং উদারনীতি (Liberal policy) এই নীতির ফলে প্রাইমারী স্কুলের সংখ্যা বাড়লেও কলেজের সংখ্যা কমে যায়। লর্ড কার্জন মানউন্নয়নের জন্য এই নীতি দেন কিন্তু ভারতীয়রা ও তার বিরুদ্ধে সমালোচনা করে। তিনি শিল্পক্ষেত্রে যে পরিবর্তনগুলো আনলেন তা ভারতীয়দের পছন্দ হলো না। বাঙালিদের বক্তব্য হলো তিনি তার গোপন উদ্দেশ্য চাপা রেখে ভালো দিক উপস্থাপন করছে অর্থাৎ kemofles।
বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সুপারিশমালা এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা আইনের বিভিন্ন ধারাগুলো এদেশবাসীকে সন্তুষ্ট করার পরিবর্তে বিক্ষুব্ধ করল। কারণ তাঁরা আইনটিকে জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী বলে চিহ্নিত করলেন। তাঁদের এ উপলব্ধি অমূ লকও ছিল না। ১৯০১ সালের শিক্ষা সম্মেলনে এক ভারতবাসীও আমন্ত্রিত হননি। বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনেও প্রথমে ভারতের কোন বিশিষ্ট্য ব্যক্তির স্থান হয়নি। পরে সাত পাঁচ ভেবে কর্তপক্ষ ড. গুরুদাস বন্দোপাধ্যায় এবং সৈয়দ হোেসন বিলম ামীর নাম অন্তর্ভূক্ত করেন। এদেশবাসী আশা করেছিলেন যে, উচ্চ শিক্ষা ও গে বষণার কাজে সরকার যথেষ্ট অর্থ সাহায্য করবেন। দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্ররাও যথেষ্ট সংখ্যক বত্তি পেয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভে ধন্য হবেন। কিন্তু বাস্তবে কিছুই হলো না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটের সদস্য সংখ্যা হ্রাস করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুে লাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার সরকারী চক্রান্ত এদেশবাসী ভাল করেই বুঝতে পারলেন। কার্জনের কর্তত্বাধীন যে বিশ্ববিদ্যালয় আইনটি বিধিবদ্ধ হলো তাতে কেন্দ্রীয় সরকাে রর নিয়ন্ত্রণ বলবৎ রইল। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, বিশ্ববিদ্যালয় আইনের দ্বার দেশবাসীর আশা-আকাংখা পূরণ না হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উচ্চ শিক্ষার বাহন হিসেবে পরিণত করার একটি শুভ সংকল্প ব্যক্ত হয়েছিল।
পোস্ট ট্যাগ:
লর্ড কার্জনের শিক্ষা নীতি আলোচনা কর,লর্ড কার্জনের শিক্ষা নীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য কি ছিল।
No comments
Do leave your comments