ক্রিপস মিশন কী ? এ মিশনেরগুলোর সুপারিশগুলো কি ছিল ?মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের এ মিশনের প্রতি প্রতিক্রিয়া কি ছিল?
ক্রিপস মিশন:
ভরতের শাসনতান্ত্রিক সংকট নিরসনের উদ্দেশ্যে মার্চ-এপ্রিল মাসে স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপস নামক একজনে ১৯৪২ সালের ব্রিটিশ ক্যাবিনেট মন্ত্রী ভারতে আগমন করেন (২২ মার্চ ১৯৪২)। এই মিশনটি ক্রিপস মিশন " নামে খ্যাত।
ক্রিপস মিশনের প্রস্তাবগুলো হলঃ
১.এ. এই প্রস্তাবে বলা হয় যে, যুদ্ধের পর ভারতকে ডোমিনিয়ান এর মর্যাদা দেওয়া হবে।
২. যুদ্ধের পর ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংবিধান সভা গঠন করা হবে ।
৩. সংবিধান সভার সদস্যগন প্রাদেশিক আইনসভাগুলির নিম্নকক্ষ দ্বারা নির্বাচিত হবেন এবং দেশীয় রাজ্যগুলির প্রতিনিধিরা দেশীয় রাজাদের দ্বারা মনোনীত হবেন।এই সংবিধান সভা ভারতের জন্য নতুন সংবিধান রচনা করবে।
৪. ভারতের কোনো প্রদেশ বা দেশীয় রাজ্য এই সংবিধান গ্রহণে রাজি না হলে সেই আদেশ বা দেশীয় রাজ্য নিজস্ব সংবিধান রচনা করে নেবে।
৫.সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যনত সেনাবাহিনীর উপর ব্রিটিশ সরকার পূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় রাখবে।
৬.বড়লাটের কার্যনির্বাহী পরিষদে আপাতত ভারতীয় সদস্য বেশি সংখ্যায় নিয়োগ করা হবে।
এসব প্রস্তাব নিয়ে ক্রিপস মিশন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করে। কিন্তু উভয় দলই ক্রিপস মিশন এর প্রস্তাবের আলোচনা করে এবং তা প্রত্যাখান করে।
ক্রিপস এর প্রস্তাব প্রত্যাখান করার পেছনে কংগ্রেসের যুক্তিঃ
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মার্চ ভারতে ক্রিপস মিশন আসে এবং এক সাংবাদিক সম্মেলনে ত্রিপস তার প্রস্তাবের খসড়াপত্র পেশ করেন। এই খসড়া দেশের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলি এবং ভারতীয় জনসাধারনের মধ্যে নানান ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ক্রিপস এর প্রস্তাব প্রত্যাখান করার পিছনে কংগ্রেসের যুক্তি নিচে দেওয়া হলোঃ
১. ভারতীয়গণকে কেন্দ্রীয় শাসন পরিষদে অংশগ্রহণের সুযোগ না দেওয়া : ক্রিপস প্রস্তাবে তাৎক্ষনিকভাবে ভারতীয়গনকে কেন্দ্রীয় শাসন পরিষদে অংশগ্রহণের সুযোগ না দেওয়ায় কংগ্রেস ক্ষুব্ধ হয়। তাছাড়া ও যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব বিট্রিশদের হাতে রাখার নীতি ও কংগ্রেস মোনেতে পারিনি।
কংগ্রেস এই প্রথার বর্জন করলে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোও ক্রিপস প্রস্তাবগুলো বর্জন করে । গান্ধিজি এই সাবকে "একটি ফেল পড়া ব্যাংকের অনুকূলে প্রদত্ত চেক (A post-dated cheque on a crashing Bank) বলে অভিহিত করেছেন।
২. গণপরিষদে দেশীয় রাজ্যের প্রতিনিধি উক্ত রাজ্যের জনগণ কর্তৃক নির্বাচনের বিধান না থাকায় পক্ষান্তরে দেশীয় রাজ্যসমূহ বসবাসরত নয় কোটি মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় যা কংগ্রেসের নিকট গ্রহনযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি।
৩. ক্রিপসের প্রস্তাবে ভারতের প্রদেশগুলোকে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে যোগদানের ব্যাপারে স্বাধীনতা দেয়ায় ভারতীয় ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট হবে যা কংগ্রেসের দাবীর বিপরীত।
৪. সর্বোপরি, ক্রিপসের প্রভাবে পাকিস্থান প্রতিষ্ঠার বীজ নিহিত থাকায় কংগ্রেস এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে।
ক্রিপসের প্রস্তাব প্রত্যাখান করার পেছনে মুসলিম লীগের যুক্তিঃ
ক্রিপসের প্রস্তাবের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার ভারতে একাধিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে মুসলিম পাকিস্থান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবীকেই স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও মুসলিম লীগ নিম্নলিখিত কারণে ক্রিপন প্রস্তাব লীগের প্রত্যাখান করে :
১. ক্রিপস মিশনের প্রস্তাবগুলোতে বৈপরিত্য ছিল। ক্রিপসের প্রস্তাবের মুখবন্ধে একটি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয় যা ছিল মুসলিম লীগের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবীর পরিপন্থী।
২.ক্রিপস প্রস্তাবে একটি মাত্র গণপরিষদ গঠনের কথা বলা হয়েছিল এবং উক্ত গনপরিষদে মুসলমান প্রতিনিধি প্রেরণের প্রস্তাব মুসলীম লীগ সমর্থন করতে পারেনি।
৩.গনপরিষদের প্রতিনিধি নির্বাচনের যে নিয়ম প্রস্তাব করা হয় তা মুসলমানদের এতদিনের দাবীকৃত "পৃথক নির্বাঞ্জনমন্ডলীর মাধ্যমে নিজস্ব নির্বাচনের" দাবীর পরিপথন্থী ছিল।
৪. প্রদেশগুলো কোন যুক্তিতে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের যোগদান করবেন সে ক্রিপসের প্রস্তাবে পাকিস্থান প্রতিষ্ঠার কোনো সুস্পষ্ট ঘোষণা ছিল না।
৫.অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের সময় মুসলিম লীগের অংশীদারিত্ব ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ছিল না।
উপসংহার: ক্রিপস মিশন স্বাধীনতার দিকে ভারতের যাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে দাড়িয়েছে। যদিও এটি ভারতীয় আকাঙ্খা এবং ব্রিটিশ ছাড়ের মধ্যে ব্যবধান দূর করেতে সফল হয়নি, এটি একটি অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছিল, ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে আরও গতিশীল করেছিল। মিশনের প্রস্তাবনা এবং পরবর্তীতে প্রত্যাখান সম্পূর্ণ স্বাধীনতার গতিকে ত্বরান্বিত করেছিল, ক্রিপস মিশন 1947 সালে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে চূড়ান্ত বিজয়ে এর দিকে ঠেলে দেয়। ক্রিপস মিশনটি ভারত স্বাধীনতার জন্য তাদের লড়াইয়ে ভারতীয় জন- গনের স্থিতিস্থাপকতা এবং সংকলোর একটি প্রমান হিসেবে রয়ে গেছে। স্বাধীনতার পথে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন পরাস্ত করার একটি মর্মস্পর্শী অনুস্মারক।
No comments
Do leave your comments