আলীগড় আন্দোলন কি?আলীগড় আন্দোলন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী?
আলীগড় আন্দোলন কি?আলীগড় আন্দোলন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী?
সূচনা:
পিছিয়ে পড়া মুসলিম শিক্ষার্থীদের কে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের আলীগড় আন্দোলন গড়ে তোলেন স্যার সৈয়দ আহমেদ খাঁ যা ইতিহাসে আলীগড় আন্দোলন নামে পরিচিত।স্যার সৈয়দ আহমদ খাঁ ছিলেন আলীগড় আন্দোলনের মূল প্রবর্তক। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহের পর অনগ্রসর মুসলিম সমাজে কিছু কিছু সংস্কারের প্রয়োজন অনুভূত হয় । হিন্দুদের তুলনায় পাশ্চাত্য শিক্ষায় উদাসীন মুসলিম সমাজের দুরবস্থার কথা স্যার সৈয়দ আহমেদ খাঁ অবগত ছিলেন । কাজেই মুসলমানদের আধুনিক ও সময়োপযোগী শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে আলীগড় আন্দোলন গড়ে ওঠে।
আলীগড় আন্দোলন কি?
মুসলমান সমাজে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে এবং স্বতন্ত্র্য জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য স্যার সৈয়দ আহমেদ খাঁ ভারতের উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ে যে আন্দোলনের সূচনা করেন তা আলিগড় আন্দোলন নামে পরিচিত।
আলীগড় আন্দোলনের পটভূমিঃ
উনবিংশ শতাব্দীতে, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে আলীগড় আন্দোলন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। আলীগড় আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে স্বতন্ত্র্য জাতীয়বােধের বিকাশ ঘটে।
এ আন্দোলনের ফলে ইংরেজদের সাথে মুসলমানদের সহযােগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। মুসলমানরা ইংরেজি ও পাশ্চাত্য-শিক্ষা গ্রহণ করে সরকারি চাকরির সুযােগ পায়। এ আন্দোলনের ফলেই ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ জন্মলাভ করে এবং পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতার পটভূমি তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
আলীগড় আন্দোলনের উদ্দেশ্য
সৈয়দ আহমদ খান আলীগড় আন্দোলনের তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য উল্লেখ করেন। যেমন,
১. ভারতের মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষা লাভে প্ররোচিত করা। কারণ তখন মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষার বিরুদ্ধে ছিল।
২. ব্রিটিশ সরকারের প্রতি মুসলমানদের মধ্যে আনুগত্যের চেতনা জাগানো। সে সময় মুসলমানরা ব্রিটিশদের ভারতের শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।
৩. ব্রিটিশদের বোঝানো যে মুসলমানরা ভারতের অনুগত নাগরিক।
এছাড়াও আলীগড় আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নিম্নরূপ:
★ভারতের রাজনীতিতে মুসলিমদের অধিকার ও আধুনিক শিক্ষা নিশ্চিত করা।
★মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটানাে।
★ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অনুগত হওয়া এবং সরকারের কর্মকাণ্ডে সহযােগিতা করা।
★মুসলমানদের স্বতন্ত্র্য জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা।
★রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করা।
★বিশ্বসভ্যতায় মুসলমানদের অবদান সম্পর্কে সচেতন করে তােলা।
★মুসলিম সমাজে নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধি, পর্দা প্রথার অপসারণ ও নারী শিক্ষা প্রসারের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে।
★মুসলিমদের আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা।
আলীগড় আন্দোলনের কার্যাবলি
আলীগড় আন্দোলনকে সফল করার জন্য স্যার সৈয়দ আহমদ ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন । আলীগড় আন্দোলনের ক্ষেত্রে গৃহীত কার্যাবলিগুলো নিম্নে বর্ণনা করা হলো।
১. বই প্রকাশনা : আন্দোলনের প্রারম্ভে স্যার সৈয়দ আহমদ কতিপয় প্রসিদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেন। ১৮৫৯ সালে তিনি শিল্পবিপ্লবের কারণ ও ঘটনাবলি যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করে 'আলবান-ই-ভাগাওয়াত হিন্দ' (উর্দু) শীর্ষক গ্রন্থ রচনা করেন।
২. পত্রিকা প্রকাশ : পত্রিকা প্রকাশ করে জনসাধারণকে সচেতন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ১৮৬৬ সালে বিজ্ঞান সমিতির পক্ষ থেকে “আলীগড় ইনস্টিটিউট গেজেট"নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হয়। ১৮৭০ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ খান মুসলিম সমাজের রীতিনীতি সংস্কারের জন্য 'তাহজিবুল আখলাক' নামে উর্দু ভাষায় একটি পত্রিকা বের করেন।
৩. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন : শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য স্যার সৈয়দ আহমদ খান ১৮৭৫ সালে আলীগড়ে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৭৭ সালে এটি 'মোহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজে' উন্নীত হয় এবং পরে ১৯২০ সালে মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় নাম ধারণ করে।
৪. মুসলিম সাহিত্য সমাজ : মুসলমানদের মধ্যে থেকে উন্নত চিন্তাধারার প্রসার, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রয়োজনীতা সম্পর্কে সচেতন করে তোলা এবং ইংরেজি শিক্ষা সম্পর্কে গোঁড়া মুসলমানদের বিদ্বেষ দূর করার লক্ষ্যে ১৮৮৬ সালে মোহামেডান এডুকেশন্যাল কনফারেন্স বা মুসলিম সাহিত্য সমাজ গঠন করা হয়।
৫. দুর্ভিক্ষ নিবারণী সমিতি : স্যার সৈয়দ আলী আহম্মদ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় দুর্ভিক্ষ নিবারণী সমিতির কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হন। একনিষ্ঠ ও নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে আলী আহমদ অসংখ্য মানুষের জীবন রক্ষা করতে পেরেছিলেন।
৬. বিজ্ঞান সমিতি : স্যার সৈয়দ আহমদ ১৯৬৩ সালে গাজীপুরে বিজ্ঞান সমিতি গঠন করেন। পরবর্তীতে এটিকে আলীগড়ে স্থানান্তরিত করেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল জ্ঞানবিজ্ঞান সম্পর্কে আলোচনা, প্রচার, পাশ্চাত্য শিক্ষার সম্প্রসারণ এবং বিভিন্ন গ্রন্থ ইংরেজি ও উর্দুতে অনুবাদ করা।
আলিগড় আন্দোলনের প্রভাব
আলীগড় আন্দোলনের অগ্রগতিতে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের প্রভাব অপরিসীম। যেমন,
১.১৮৫৮ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ খান একটি ফার্সি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে ইংরেজি শিক্ষাও দেওয়া হয়।
২.১৮৬৩ সালে, তিনি বিখ্যাত ইংরেজি বইগুলোকে উর্দুতে অনুবাদ করার উদ্দেশ্যে গাজীপুরে একটি বৈজ্ঞানিক সমিতি (scientific society) প্রতিষ্ঠা করেন।
৩.১৮৬৬ সালে, বিজ্ঞানীরা "আলিগড় ইনস্টিটিউট গেজেট" নামে একটি জার্নাল প্রকাশ করতে শুরু করেন।
৪.মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষাকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে স্যার সৈয়দ “আঞ্জুমান-ই-তারকি-ই-মুসলমান হিন্দ” প্রতিষ্ঠা করেন।
৫.তিনি জীবনের বিভিন্ন দিক সংস্কারের জন্য "তেহজেব উল আখলাক (Tehzeb ul Akhlaq)" নামে একটি জার্নাল প্রকাশ করেন।
৬.তিনি আঞ্জুমান মুহাম্মদান প্রতিষ্ঠা করেন।
৭.১৮৭৫ সালে, অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে আলিগড়ে মহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ (Muhammedan Anglo-Oriental College) প্রতিষ্ঠা করেন। সৈয়দ আহমদ কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করতে চেয়েছিলেন, পারেন নি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর, ১৯২১ সালে এটিকে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করে।
৮.১৮৮৬ সালে মুহাম্মাডান এডুকেশনাল কনফারেন্স স্থাপিত হয়। এতে মুসলিম শিক্ষাবিদদের নিয়ে গঠিত যার উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের জন্য শিক্ষার মান নিশ্চিত করা,
৯.শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া এবং শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য গবেষণা পরিচালনা।
আলীগড় আন্দোলনের ফলাফল
আলীগড় আন্দোলন ছিলো ভারতের মুসলমানদের পরিবর্তনের আন্দোলন। এ আন্দোলনের ফলাফল ছিল সদূর প্রসারি। নিম্মে আলীগড় আন্দোলনের ফলাফল বর্ণনা করা হল।
আলিগড় আন্দোলন মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে তাদের আধুনিক যুগোপযোগী ভাবধারায় দীক্ষিত করেছিল।
এই আন্দোলন ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে যুক্তিবাদের প্রসার ঘটিয়ে তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামি পরিত্যাগেও সাহায্য করেছিল।
মুসলমানরা কোন না কোনভাবে ইংরেজী শিক্ষা লাভে রাজি হয়।
আলীগড় আন্দোলন ছিল ভারতে মুসলিম নেতৃত্বের একটি বড় উৎস।
মুসলমানদের প্রতি ব্রিটিশদের মনোভাব নরম হয়।
ভারতীয় মুসলিম লীগ তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
আন্দোলনের মাধ্যমে দ্বি-জাতি তত্ত্ব শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং এর প্রতি আরও পাণ্ডিত্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়।
পাকিস্তানের সৃষ্টির শিকড় আলিগড় আন্দোলনে খুঁজে পাওয়া যায়।
উপসংহারঃ
আলীগড় আন্দোলনের ফলে মুসলিম সম্প্রদায় তাদের জাতীয়তাবাদের বিকাশ, অধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের বিষয়ে সচেতন ও জাগ্রত হয়। মুসলিম সমাজ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষায় নিজেদের সমৃদ্ধ করে তোলেন। আলিগড় আন্দোলনের অবদান প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার মন্তব্য করে বলেছেন যে,
“উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণ ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিন্দুদের কাছে যা ছিল, আলিগড় আন্দোলনও ছিল মুসলিমদের কাছে ঠিক তাই”।
পোস্ট ট্যাগঃ
#আলীগড়আন্দোলনকি#আলীগড়আন্দোলনলক্ষ্যওউদ্দেশ্যকী#আলীগড়আন্দোলনকিpdf#আলীগড় আন্দোলনবৈশিষ্ট্য
No comments
Do leave your comments