ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমন এবং আধিপত্য বিস্তার বর্ণনা কর?
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমন এবং আধিপত্য বিস্তার বর্ণনা কর?
ভূমিকা: ভারতে ইংরেজ আধিপত্য (অথবা কোম্পানি রাজ হিন্দিতে রাজ শব্দের অর্থ শাসন) বলতে বোঝায় ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন । ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের বাংলার নবার কোম্পানির হাতে পরাজিত হলে কার্যত এই শাসনের সূচনা করে। ১৭৬৫ সালে কোম্পানি বাংলা ও বিহারের দেওয়ানি লাভ অর্থাৎ রাজস্ব সংগ্রহের অধিকার লাভ করে এবং প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে নিযুক্ত করে প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্যে - কল গ্রহণ করেন। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর ১৮৫৮ সালের ভারত শাসন আইন বলে ব্রিটিশ সরকার ভারতের প্রশানিক দায় দায়িত্ব স্বহস্তে খুলে নয় এবং দেশে নতুন ব্রিটিশ রাজ প্রবর্তিত হয় ।
বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোমপানির আগমন :-
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বলা হয় পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রথম কর্পোরেশন কোম্পানি। শুরুতে এর নাম ছিল English East india company (১৬০০-১৭০৪) পরবর্তীতে এর নাম বদলে রাখা হয়
Honourable Company of Marchents of London Trading into the East Indies। তবে উপমহাদেশে সেটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামেই অধিক পরিচিত ছিল।
পূর্ব ইউরোপের মানুষের কাছে ভারতীয় উপমহাদেশ * East India" নামে পরিচিত ছিল। সেই সময় ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল মশলা, কাপত এবং পাখি রত্নের জন্য বিখ্যাত এক জ্ঞান । এসব উপকারণ ইউরোপে বেশ চড়া মনে বিক্রি করা হতো। কিন্তু সমুদ্রে শক্তিশালী নৌবাহিনী না থাকার দরুন ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে আসতে ব্যর্থ হয়।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোমপানির আধিপত্য বিস্তার :
বাংলায় ইংরেজ রাজত্ব একদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তা মনে করা ভূল যে, পলাশীর বিপর্যয় একটি মাত্র বিশ্বাস ঘাতকতার ফল। যখন থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে শুভ অর্থাৎ ১৬৩৩ সালে তখন থেকেই রচিত হতে থাকে পলাশীর পটভূমি।
কোম্পানির আধিপত্য বিস্তারের প্রধান প্রধান ধাপসমূহ:
১৬৬৬ সালের মে মাসে মহানদীর মুখে হরিহরপুরে ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। দীর্ঘকাল পর তারা ১৬৫১ সনে হুগলী শহরে আরেকটি কুঠি স্থাপন করেন। এই বৎসর বাংলার সুবাদার শাহজাদা সুজা ইংরেজদের এদেশে বিনা শুল্কে অবাধ বাণিজ্য করার অধিকার দেন। শর্ত ছিল এই যে কোম্পানি সরকারকে বাৎসরিক মাএ তিন হাজার টাকা রাজস্ব দেবে এতে অবাধ বাণিজ্য করার সুযোগ লাভ করে কোম্পানি তার বাণিজ্য দ্রুত সম্প্রসারন করতে থাকে।যেসব স্থানে নতুন কঠি স্থাপন করা হয় তাদের মধ্যে প্রধান হচ্ছে কাসিমবাজার(১৬৫৮)পাটনা(১৬৫৮), ঢাকা (১৬৬৮) রাজমহল ও মালদহ।১৬৮০ সন নাগাদ কোম্পানির বাণিজ্য দেশের সর্বত্র বিস্তার লাভ করে। বাণিজ্য, বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পায় সরকারের বিরুদ্ধে কোম্পানির নানা অভিযোগ । কোম্পানির অভিযোগ ছিল যে সরকারি কর্মচারীদেরকে কোম্পানির কর্মচারিদের অযথা হয়রানি করে। উৎপীড়ন করে উৎকোচ দিতে বাধ্য করে ইত্যাদি সরকারের ও অভিযোগ ছিল সে কোমপানি সাত মোতাবেক বাণিজ্যনা করে অসদুপায় অবলম্বন করছে।
কোম্পানির আত্তরঙ্গজেবের সাথে শান্তি চুক্তিঃ
কোম্পানির কর্মচারীদের অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগকে কেন্দ্র করে ১৬৮৬ সনে মুঘল সরকার ও এই কোম্পানির যুদধ শুরু হয়। ১৬৮৯ সনে পর্যন্ত এই যুদধ হয়।
১৬৯০ সনে কোম্পানি - আত্তরঙ্গজেবের সাথে একটি শান্তিচুক্তি হয়।সেই চুক্তি মোতাবেক কোম্পানি সারাদেশে বাৎসরিক তিন হাজার টাকা রাজস্বের বিনিময়ে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার পায়। কোম্পানির এজেন্ট জব চার্নক সুতানটি নামক গ্রামে তার দফতর স্থাপন করে ভবিষ্যৎ কলকাতা নগরী ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন।১৬৯৮ সানে কোম্পানি কলকাতা সুতানটি ও গোবিন্দপুর এই তিনটি গ্রামের জমিদারি সনদ লাভ করে।১৬৮৯ সনে কলকাতায় ইংল্যান্ডের তৎকালীন রাজা উইলিয়ামের নামানুসারে ফোর্ট নামক দুর্গ নির্মিত হয় । মুঘল সরকার তখনও বুঝতে পারেননি যে, এই জমিদারী ধীরে ধীরে প্রসারিত হয়ে একদিন সারা দেশই কোম্পানির রাজত্বে পরিণত হবে।
সম্রাট ফররুখশিয়রের থেকে ফরমান লাভঃ
কোম্পানির আধিপত্য বিস্তারের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ ধারা সম্রাট র ফররুখশিয়রের থেকে ফরমান লাভ (১৭১৭)। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর (১৯০৭ খৃঃ) পর থেকে সিংহাসন ও অন্যান উচ্চপদ নিয়ে বিবাদ ও গৃহযুদধ ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। কোম্পানি প্রত্যেককে প্রয়োজনীয় উৎকোচ ও পুরস্কার দিয়ে নানা রকম সুযোগ সুবিধা আদায় করার চেষ্টা করে। ১৭১৩ সালে গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে ফররুখশিয়ার সম্রাট হলে কোম্পানি তাকে প্রচুর পুরুস্কার দান করে এবং পরিবর্তে লাভ করে অভূতপূর্ব বাণিজ্যিক ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা প্রবন্ধিত ফররুখশিয়ারের ফরমানের প্রধান ধারাগুলো নিম্নরুপঃ
১.কোম্পানি সরকারকে বাৎসরিক মাত্র ৩ হাজার দানের পরিবর্তে সারাদেশে বিনা গুল্কে অবাধ বাণিজ্য করবেন।
২.কোম্পানির মালামাল কোথাও চুরি হলে সরকার তা
ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে বা সমমূল্যের ক্ষতিপূরণ দিবে।
৩.কোনো শুল্ক চৌকিতে কোম্পানির নৌকা-জাহাজ কোনো রকম অজুহাতে আটক করা যাবে না।
৪.মুর্শিদাবাদের টাকশালে কোম্পানি তার নিজস্ব টাকা তৈরি করবে।
৫. সুবাদার কলকাতার 'আশে পাশে আর ৩৮ টি গ্রামের উপর জমিদারি সনদ কোম্পানিকে দেবে।
৬.কোম্পানির অধীনস্থ কর্মচারীদের বিচার করার অধিকার কোম্পানির থাকবে।
কররুমাশয়রের ফরমান দ্বারা দেশের সার্বভৌমত্বকে আংশিক ভাবে বিলিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
চূড়ান্ত আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় পলাশীরযুদ্ধ : :
প্রত্যেক সুবাদার অতি কৌশলে কোম্পানির সঙ্গে সরাসারি দ্বন্দে এড়িয়ে চলেন। কিন্তু আলীবর্দী খানের মৃত্যুর (১৯৫৬)পর সেই কৌশলের রাজনীতির অবসান ঘটে এবং সেই সঙ্গে শুরু হয় এই দেশে কোম্পানির আধিপত্য বিস্তারের তৃতীয় পর্যায়।
আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারী সিরাজউদ্দৌলার বিরুদেরও শুরু হয় ষড়যন্ত্র । ইংরেজদের ষড়যন্ত্র এবং প্রসাদ ষড়যন্ত্রের স্বীকার হন নবাব সিরাজউদ্দৌলার, ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন সিরাজ উদ্দৌলার সাথে ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর প্রান্তরে মেকি যুদধ হয়। পলাশীর প্রান্তরে সিরাজউদ্দৌলার পরাজিত হওয়ার ধরা পরে নিহত হন।
এরপর লর্ড ক্লাইভ এদিকে আবার দেশে ফিরে আসেন সরকারের ইংরেজ গভর্নর নিযুক্ত হয়ে। তিনি তখন দিল্লির বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে (১৭৬৫ সালের ১লা আগস্ট)এতে নবাব ক্ষমতাহীন দায়িত্ব এবং কোম্পানি দায়িত্বহীন ক্ষমতা লাভ করে। ফলে সেই অঞ্চলে দ্বৈত শাসন এর সৃষ্টি হয়। এরপর বাংলায় অনাবৃষ্টি ও কোম্পানির অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের ফলে ১৭৭০ বা বাংলা ১১৭৬ সনে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়।
বণিক থেকে রাজনঃ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে এসেছিল বাণিজ্য করার লক্ষ্য নিয়ে। কিন্তু অবস্থা বুঝে তারা ব্রিটিশ রাজ্যের শাসনকর্তা হিসাবে আবির্ভূত হয়। এজন্য কবি লিখেছেনঃ
"বনিকের মানদন্ড
পোহালে শর্বরী
দেখা দিল
রাজদন্ড রুপে"
উপসংহারঃ
বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম বছরের শাসনই কুখ্যাতি অর্জন করে। কোম্পানির দ্বৈত নীতি ও কোম্পানির কর্মকর্তাও কর্মচারীদের সীমাহিন দুর্নীতির কারণে বাংলায় দুভিক্ষ সৃষ্টি হয় ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডি কোম্পানির অবসান ঘটে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তর:
★ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম শাসনকর্তা কে ছিলেন?
উত্তর: ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত এক শ বছর এ দেশে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কোম্পানির শাসন চলে। ইতিহাসে যা কোম্পানির শাসনকাল নামে পরিচিত। কোম্পানির প্রথম শাসনকর্তা ছিলেন লর্ড ক্লাইভ।
★ইংরেজরা প্রথম কোথায় বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে ?
উত্তরঃ১৬৬৬ সালের মে মাসে মহানদীর মুখে হরিহরপুরে ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে।
পোস্ট ট্যাগ:
#ইস্টইন্ডিয়াকোম্পানিরআগমন#ইস্টইন্ডিয়াকোম্পানিরআধিপত্য#ভারতেইস্টইন্ডিয়া#ইস্টইন্ডিয়াকোম্পানি
No comments
Do leave your comments